ধৈর্যশীল বিকল্পের খোলা চিঠি

৬ই আগস্ট ২০২৪ বা ৩৭ জুলাই ২০২৪ যেভাবেই বলি না কেন, ৩০ জন ব্যক্তির একটি কালেক্টিভ একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে স্বৈরতন্ত্রের পতনের জন্য অভিনন্দন জানায় এবং এই নতুন বাংলাদেশকে বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষেরা কীভাবে দেখতে চায় তার প্রস্তাবনা হাজির করে। ধৈর্য্যশীল বিকল্প একদল গবেষক ও এক্টিভিস্টদের সংঘ। অ্যাজিটেট! তাদের চিঠি ও দাবিগুলো নিম্নে পুনঃপ্রকাশ করছে।


“আমরা বিশেষ কোন সংস্কৃতির জন্য বিদ্রোহ করি না। আমরা বিদ্রোহ করি কারণ, অনেক কারণে আমরা আর শ্বাস নিতে পারি না” – ফ্রান্টজ ফ্যানন

“একটি সরকার বা একটি দল তার প্রাপ্য জনগণ পায় এবং পরবর্তী কোন সময়ে জনগণ তার প্রাপ্য সরকার পায়।” – ফ্রান্টজ ফ্যানন, দ্য রেচড অফ দ্য আর্থ

পাহাড়ে যে অত্যাচার করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে এক সময় সে নিপীড়ন চলে আসে সমতলে ’” -কল্পনা চাকমা

প্রিয় পাঠক,

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন এমন কয়েকজন একটিভিস্ট এবং গবেষক এই উদ্যোগটি নিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ এবং সংকলন করার পরে আমরা এই নোটটি তৈরি করেছি যাতে এখানে অংশগ্রহণকারীদের চিন্তাভাবনাগুলোও উঠে আসে । সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক কুইয়্যার এবং ট্রান্সজেন্ডার ছাত্ররাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু আন্দোলনে তাদের অবদানকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি। আমরা, লেখক এবং অংশগ্রহণকারীরাও সামরিক শাসনের প্রতি ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনে উদ্বিগ্ন ছিলাম এবং জোর দিয়ে বলতে চাই যে বিজিবির জায়গা রাস্তায় নয় সীমান্তে এবং লড়াইটি গণতন্ত্রের, সামরিক শাসনের পুতুল সরকারের জন্য নয়।

কুইয়্যার/এলজিবিটিকিউ/ লিঙ্গ এবং যৌন বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে আমাদের আকাঙ্খা এবং স্বপ্ন সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব মতামত সংগ্রহ করতে এবং এটিকে জনসাধারণের সামনে নিয়ে আসার প্রয়াস হিসেবে ৫ই আগস্ট ২০২৪-এ, একটি ফর্ম অনলাইনে এবং বন্ধুদের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। আমরা মূলত তাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে চাই, যারা বৈষম্য দূর করে একটি মুক্ত ও সাম্যের সমাজ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে।

যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে: সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ, ধর্মীয় মৌলবাদের অবসান, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সুরক্ষা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব, রাজনীতিতে যুবক ও সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সাংবিধানিক, আইনি ও রাজনৈতিক সংস্কার এবং শীঘ্রই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।

মেথডলজিঃ

ফরমটি দশ ঘন্টা সময়ের জন্য অনলাইন ছিল এবং এই সময়ের মধ্যে ৩০ জন অংশগ্রহণকারী নিজেদের মতামত দিয়েছে, তাদের মতামত স্নোবল পদ্ধতি ব্যবহার করে সংগ্রহ করা হয়ে ছিল। ফরমের উল্লেখযোগ্য কিছু প্রশ্ন ছিলঃ

– আপনি কি সরকারে নিজের প্রতিনিধিত্ব দেখতে চান?
– নতুন সরকার নিয়ে আশা, দাবি ও শঙ্কা
– বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য
– তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য নাম সুপারিশ

জাতি পুনর্গঠন করতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের আমরা একটি বহুত্ববাদী অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র অনুসরণ করতে উৎসাহিত করি, যেখানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে, সংসদীয় অনুশীলনে সবার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এই আকাঙ্ক্ষাগুলি কে প্রতিফলিত করার জন্য সামাজিক অবকাঠামো – স্কুল, মিডিয়া, সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য সেক্টরগুলিকে কথা বলার সুযোগ দেয়া উচিত এবং ভিন্নমতকে উৎসাহিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, আমরা কেবল অংশগ্রহণকারীদের মতামতকে সংকলন করেছি, সকল মতামতকে আমরা সম্পাদকরা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন না-ও করতে পারি এবং এখানে উঠে আসা মতামতসমূহ সমগ্র কমিউনিটি কিংবা সম্পাদকদের মতামতকে প্রতিফলিত করে না।

আমরা আশা করি, সকলের মানবাধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা সবাই ২০২৪- এ শুরু হওয়া এই মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। সকলে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জুলাই ‘২৪ শেষ হবে না।

শক্তি এবং সংহতিতে ,
ধৈর্যশীল বি কল্প

দাবীসমূহ

● লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারসমূহ, যেমনঃ বাক-স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, উন্নত সাইবার নিরাপত্তা, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, “সংখ্যালঘু” অধিকার, পরিবেশগত অধিকার, বিরোধীদের অধিকারসহ সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। উত্পীড়ন এবং হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ট্রান্স প্রোটেকশন বিল পাস এবং বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করতে হবে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। সংবিধানের ২(ক) ধারা বাতিল করতে হবে।

● লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ের আইনি এবং সামাজিক স্বীকৃতি (377 বাতিল, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি )। “তৃতীয় লিঙ্গ” ধারণার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। সমস্ত লিঙ্গ এবং যৌন পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে। সম্পত্তির অধিকার, বিবাহের অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এবং লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ের জন্য একটি নিরাপদ ডিজিটাল স্পেস নিশ্চিত করতে হবে।

● ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু বাঙালী মুসলিম পুরুষদের স্বার্থ রক্ষা করা উচিত নয়। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিতে হবে। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। ক্ষমতায় থাকা পুরুষদের আরও শিক্ষিত, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংবেদনশীল হতে হবে।

● ধর্মীয় ও জাতিগত “সংখ্যালঘুগোষ্ঠীর” অধিকার সুরক্ষায় বিশেষ কমিশন, “আদিবাসী” শব্দটি গ্রহণ এবং স্বীকৃতি দেওয়া এবং পার্বত্য এলাকা থেকে সামরিক বাহিনীকে সরাতে হবে।

● উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা এবং দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন। অবকাঠামো নয়, বরং জনগণ কেন্দ্রীক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ।

● সংসদে প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা উচিত। এছাড়াও সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় নারী, জাতিগত “সংখ্যালঘু” এবং হিজড়াদের জন্য কোটা থাকা উচিত। চাকরি পেতে বয়সের কোন সীমা থাকা উচিত নয়।

● নারী ও শিশুদের জন্য আইন সংশোধন। “ধর্ষণ” এর পরিষ্কার সংজ্ঞা থাকতে হবে। পুরুষ ধর্ষণের আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। রেপ কিট স্টোরেজ সিস্টেম উন্নত করা প্রয়োজন।

● নিত্য পণ্যের দাম কমাতে হবে।

● বিজিবিকে সীমান্তে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে পাঠাতে হবে । পুলিশি হয়রানি ঠেকাতে কঠোর আইন করতে হবে।

● অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনতিবিলম্বে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। নতুন সরকারের উচিত যুব প্রতিনিধিদের একটি উইং তৈরী করা। সাধারণ মানুষের সরকারের কাছে সরাসরি অভিযোগ এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ থাকা উচিত।